যেদিন ঘুম ভাঙলেই মনে হয় এ পৃথিবীতে এত আনন্দ এর আগে কখনও আসেনি, সেই দিনটাই অষ্টমী।
পায়ের দিকে জানালা। চোখ খুলেই দেখব বাইরে ঝকঝক করছে রোদ। দূরের ইউক্যালিপটাস গাছটার মাথায় পাশের শহর থেকে আসা তিন-চারটে পাখি। তারা আমাদের শহরে এসে অবাক হয়ে গেছে খুব; সে গল্পই করছে নিজেদের কাছে। বারোয়ারি পুজো মন্ডপ থেকে পুরুতঠাকুরের গলা ভেসে আসছে।
কেন জানিনা সকালটাকে কোনও এক রোববার মায়ের হাতে হঠাৎ তৈরি গরম পরোটা আর আলুর তরকারির মতো লাগে। আজ সারপ্রাইজ! কালো জিরে দেওয়া, ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর পাতলা ঝোল। বাটি থেকে ধোঁয়া উঠছে হালকা। পরোটার গায়ে লেগে থাকা তেলটুকুর নেশাতুর গন্ধ জেগে আছে টেবিলের ওপর। প্রথম টুকরোটা মুখে নিয়ে মনে হয় আমি নির্ঘাত এ পৃথিবীর রাজাটাজা হ’ব। এ পৃথিবীর মুষড়ে থাকা সমস্ত মানুষকে গরম গরম পরোটা আর কালোজিরে দেওয়া আলুর তরকারি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে আজ।
আজ? উঁহু, আজ তো আপাতত কিচ্ছুটি খাওয়া চলবে না। কারণ একটু পরেই অঞ্জলি দিতে যাওয়া হবে। পাড়ার পুজো। অনেকের সঙ্গে দেখা হবে। পাশের বাড়ির জেঠিমা বলবেন “কবে এলি বাবা? কেমন আছিস? খাওয়া দাওয়া একদম ঠিক করছিস না কিন্তু, রোগা হয়ে গেছিস”
অঞ্জলির পরে অবশ্য থার্মোকলের খালায় শাঁকালু থাকবে। আর আপেল- কলা- আঙুর। একটা করে কালাকাঁদ। “এখন আর কিছু খাব না মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা ওয়েট করছে না ওদিকে?”
“ঠিক আছে। কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরিস। আজ অষ্টমী, খেয়াল আছে তো?”
এই বলে ভেজানো মটরের জল ছাঁকে মা। আমি দেখি আমাদের সমস্ত দুঃখ বেসিন বেয়ে জলের মতো উধাও হয়ে যাচ্ছে। আর এক বড়-বাটি ভর্তি আনন্দ ফুটে রয়েছে মায়ের হাতে।

রোদ বেড়েছে। এখন আর পুজো মন্ডপ থেকে পুরুতঠাকুরের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাচ্ছে না। তার জায়গায় কুমার শানু। রাস্তায় নতুন শাড়ি আর পাঞ্জাবি। তারা ঝকঝক করছে আজ। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মন্ডপের সামনে ঘুগনির স্টল। একপাশে ফুচকা আর আইসক্রিম-ওয়ালা। অন্য দিকটায় চাউমিন- এগরোল- চিকেন পকোড়া।
মাকে একটু গুল মেরেছি অবশ্য— বন্ধু নয়, বান্ধবী! তাদের খোলা চুলে এই রোদ- গলা দিন আর টলটলে আকাশ জড়িয়ে থাকে। তাদের লিপস্টিক মফস্বলের মাটি- রঙের। তারা কোল্ড-ড্রিংকসের বোতলে চুমুক দিতে দিতে হেসে গড়িয়ে পড়লে মনে হয় কাশের বনে শুয়ে আছি।
“দাদা তিনটে চকোবার আর একটা বাটারস্কচ, কাপ”
বাটারস্কচটা আমার জন্যই। চকলেট ভালো লাগে না। স্বাদটার মধ্যে কেমন একটা রয়্যাল ঔদ্ধত্য আছে। আর তাই বোধহয় মিশে থাকা মনোটনিও। বাটারস্কচ সে জায়গায় স্নিগ্ধ। উপরন্তু কাপ- আইসক্রিম খাওয়ার একটা নিয়ম আছে। সৌন্দর্য আছে। আইসক্রিম জমে একেবারে শক্ত হয়ে থাকলে ভালো লাগবে না। ফটিক- স্বচ্ছ চামচটা তার গায়ে বসানোর আগে হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে সামান্য। তারপর মাঝখানে নয়। প্লাস্টিকের কাপের একেবারে গা- বেয়ে কেটে নিতে হবে অল্প। সেই হাল্কা গলে যাওয়া, এক কুচি প্রালিন মেশা, অফ-হোয়াইট স্বর্গের স্বাদ যারা পায় বান্ধবীদের সঙ্গে ভালো থাকে তারা।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটায় আড়াইটা। কড়াইতে তেল ছাড়া। লুচি বেলে রাখা আছে একপাশে। মা দ্রুত হাতে আরও কয়েকটা বেলে নেয়। গরম তেলে পড়ে পেট ফুলে উঠবে তাদের। থালায় নিয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে তার পেট ফুটো করতে গিয়ে একটা পুরো ছোটোবেলা খিলখিল করে বেরিয়ে আসবে। তারপর গরম গরম ঘুগনি।
“আরেকটা দিই?”
অষ্টমীর দুপুরে লজ্জা করতে নেই। “দাও… একটু কড়া করে ভেজো, ধার গুলো হালকা লাল হয় যেন। আর ধনেপাতা থাকলে ঘুগনির ওপর ছড়িয়ে দেবে?”
শুধু স্বাদ- গন্ধ নয়, খাবারের রঙটুকুও খুব গুরুত্বপূর্ণ। না হলে সমস্ত ছন্দ মিললেও শেষে কোথায় যেন কবিতার দু’লাইন বাকি রয়ে যায়। কোন উপকরণটুকু কী পরিমাণে এবং কতক্ষণ মেশালে একটা পদ তৈরি হয় সে ব্যাপারে চিরকালই আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। এ পৃথিবীর সমস্ত শিল্প রচনা করার, সমস্ত সৌন্দর্য সৃষ্টি করার ক্ষমতা আমার নেই। সম্ভবত তার প্রয়োজনও নেই। শুধু রসটুকু চেটেপুটে নিতে পারি যেন।
রঙের ব্যাপারটায় অবশ্য পুরোটাই আমি নিজস্ব হাইপোথিসিস কাজে লাগাই। কোনও নির্দিষ্ট পারমুটেশন- কম্বিনেশন আছে কী না, থিওরি-টিওরি আছে কী না সেসব জানিনা। যেমন ঘুগনির যে রঙ, তার ওপর সবুজ থাকতেই হবে। হয় কাঁচালঙ্কা কুচি করে ছড়িয়ে দিতে হবে, নয়ত আমার মতো ঝাল খেতে গেলে নালেঝোলে হওয়া মানুষদের জন্য সামান্য ধনেপাতা। এগরোল খেতে গিয়ে শুধু আনাড়ির মতো কামড় বসালে চলবে না। টোম্যাটো সসের লালটুকু পরোটা সহ ডিমের ফোরগ্রাউন্ডে চোখ দিয়ে দেখতেও হবে। না’হলে মিস করে যাবেন অনেকখানি।

সেই টোম্যাটো সসের মতোই একসময় সন্ধ্যে নামবে মন্ডপ আর রাস্তা জুড়ে। আকাশে অষ্টমীর চাঁদ তখন একটু জড়সড়, মাটির পৃথিবীর জৌলুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না আজ। চাউমিন আর ফুচকার স্টলের সামনে জটলা এখন। তার মধ্যেই চোখে পড়ে চেনা মুখ। সেই বান্ধবীদের প্লেটে এখন চিকেন চাউমিন আর চড়া আলোর নীচে হাসিতে লুটিয়ে পড়া অন্য মানুষ। তারা কাঁটাচামচে জড়িয়ে নিচ্ছে নিজেদের। একই শালপাতার বাটি থেকে ফুচকা খেতে গিয়ে টকজল ছিটকে পড়ছে নতুন কুর্তিতে। চোখাচুখি এড়িয়ে মিষ্টির দোকানে ঢুকি।
রাত্রে সহজ চেনা রুটি আর আলুভাজা। পাশে ছানার জিলিপি। “একটা ডিম ভেজে দাও তো মা। হালকা করে ভাজবে, ভেতরটা সাদা সাদা থাকে যেন। আর ছানার জিলিপি আরেকটা দাও। কতদিন পরে খাচ্ছি।” আজ অষ্টমী তো, লজ্জা করতে নেই।
দূর মন্ডপ থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। ইউক্যালিপটাস গাছটার মাথা দেখা যাচ্ছে দূরে। পাখিরা ফিরে গিয়েছে নিজের শহরে। আর জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার নাকে এসে লাগছে চাউমিনের একটা বেয়াড়া গন্ধ।
আনন্দের ভেতর চকোবারের মতো একটা লোভ কিন্তু অবশ্যম্ভাবী মনোটনি আছে। সাবধানে তাকে পাশ কাটিয়ে পেরোতে গিয়ে দেখি জীবনের কাপ- আইসক্রিমও পুরোটা গলে গেছে কখন।
যেদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে মনে হয় হঠাৎ বড় হয়ে গেছি সেই দিনটাই অষ্টমী।
—অনীক চক্রবর্তী

Lekhata ashtamir Anjalir motoi snigdho ..
LikeLike