“রাম খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ, কথায় কাটে কথার প্যাঁচ।”
কথার প্যাঁচ থেকে মাঠের পাঁচ-শূণ্য, গলার জোরে গোল নিশ্চিত। দুই পাড়ের ইলিশ চিংড়ি, দুই পাড়ের সাহিত্য, রান্না বা ভাষার মাধুর্যে আধিপত্য বিস্তারের নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত, আর এই আদিম লড়াইয়ের আঁচে ফুঁ দিয়ে দুধে-ভাতে আছে বাঙালি।
আমার এপাড় চেনা আমার বাবার থেকে, আর ওপাড় মা’র। কখনো এমার্জেন্সি আমলে ব্ল্যাক-আউটের রাতে বড়দাদু দরজা খুলে দিল, কারা জানি ধাঁ করে ঢুকেই পালালো খিড়কি দরজা দিয়ে। পুলিশ ও এল পিছু পিছু, “ডাক্তারবাবু ছোঁড়াগুলো এদিকে এল নাকি?” “না হে, কিছু হয়েছে ?”। আবার সব নিঃঝুম। সরসর আওয়াজে দুলল শ্যাওড়া গাছটা।
তেমনি একদিন একঝুড়ি সুপুড়ি নিয়ে শ্যামবাজারে এসে দাঁড়ালেন আমার বাঘদাদু। বিক্রি করে জোটাতে হবে সেদিনের খাবার, ব্যবস্থা করতে হবে ছাদের। সেখান থেকে পেটচুক্তির টিউশনি, রেলের চাকরি, নতুন দেশে সব হারানো সব পেয়েছির দেশ।
আমার গল্পের এইসব চরিত্ররা আজ ও বাঁচে, ছোড়দিদার পার্লে নামকিনের শিশিতে, বড়দাদুর ডায়রীতে- ছড়ানো ছেটানো। তারা গল্প শোনানো বন্ধ করার আগেই বাক্সবন্দী করছি।
খিদে পেলে হোমিওপ্যাথি গুলি ও খায় বাঙালি, মিথ্যে নয়। আহারের বাহারে তার জুড়ি নেই, একশোবার। গোহারা হারবেই ম্লেচ্ছ খাবার।
“আদিম কালের চাঁদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।”
পদ্মাপাড়ের ইলিশ লেজা ভর্তা
ছোটবেলায় একবার স্কুল থেকে ফিরে মাকে বলেছিলাম আমার নাম প্রতীতি মুর্মু রাখলে না কেনো? এরম বিকট আবদারের মতন আর যে দাবীটা প্রত্যেক পুজোয় থাকতো সেটা এরকম ‘ সবার দেশের বাড়ি আছে ,আমার সব বন্ধুরা পুজোয় দেশের বাড়ি যায়,আমার একটা দেশের বাড়ি নেই কেনো !’ স্বাগতকে বিয়ে করে আজ আমারও একখান দেশের বাড়ি হয়েছে। পুজো আসার এক মাস আগে থেকে তাই মনটা হাঁকু পাঁকু করে বোলপুর যাবার জন্য। বিয়ের পর নবমীর সকালে বোলপুর পৌঁছে সেই দেশের বাড়ির উঠোন পেরোতেই কানে আসে মাইকে গান বাজছে ‘গৌরী এলো দেখে যা লো!’ এরপর চলতে থাকে বাড়ির ১৯ জনের সঙ্গে দফায় দফায় সাক্ষাৎ এবং সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে, রাত্তির, মাঝ রাত্তির, ভোররাত্তিরের প্ল্যান ছকা। সেবার প্রথম দশমীর দিন ধনঞ্জয় কাকুর বাড়িতে ঠাকুর বরণ করতে গেছিলাম আমি। ওখানে মায়ের মুখটা বাড়ির মেয়ের মুখের মতন গড়ন পায়। লাল শাড়ি,পায়ে আলতা,ধ্যাবড়া সিঁদুর পরে ঠাকুর বরণ করবো এ আমার বহুদিনের সখ। বরণ সেরে মই থেকে নামার আগে মায়ের চিবুকটা ধরে বলতে যাবো ‘আবার এসো ‘, মনে হলো ছোটবেলায় বড়দিদা কলাবিনুনি বেঁধে দিয়ে সাজিয়ে দিয়ে আদর করতো আর এমনই চিবুক ধরে গাইতো ‘পেছপারিয়া রাজকুমারি গলায় চন্দ্রহার দিনেদিনে বাড়ছে তোমার চুলেরই বাহার৷’ বরণ সেরে ফিরে দেখি ছোটভাই একটা দৈত্যাকার ইলিশ নিয়ে এসেছে। কি কি খাওয়া যায় সবাই সবার দাবী ততক্ষনে জানিয়ে ফেলেছে । মামমাম, জেম্মা, মেমবুড়ি সেই মাছের আঁশ ছাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে।ছোটভাইয়ের মা ,আমার সম্পর্কে কাকী শাশুড়ি হলেও আমি ওঁর দুধসাদা রং দেখে মেম বুড়ি বলে ডাকি।বোলপুরে বিয়ে হলেও কলকাতার মেয়ে মেমবুড়ি আদপে ওদেশিয়।আমরা আসার আগেই ঠিক হয়ে গেছে ইলিশ মুড়ি দিয়ে কচু শাক হবে,পেটি গাদা কিছু ভাপা, কিছু কালোজিরে টমেটো দিয়ে তেল ঝোল হবে। লেজটাই শুধু বাকি আছে কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না দেখে মেম বুড়ি বলল ওর মা ফরিদপুরে থাকতে একটা দারুন রান্না শিখেছিল।ব্যাস শোনামাত্রই আমাদের জিভে জল।কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম আমি।সেই ইলিশের লেজার ভর্তা খেয়ে ছোটভাই সার্টিফিকেট দিল ‘বাম্পার হয়েছে বড়বৌদি!’ সেই শুরু তারপর থেকে বাড়িতে ইলিশ এলেই সবচাইতে কদর পায় মেম বুড়ির সেই রান্নাটা।
উপকরণ:
ইলিশ লেজা ১টা
সর্ষের তেল ৩চা চামচ
শুকনো লঙ্কা ৪টে
পেঁয়াজ ২টো
পাতি লেবু ২কোয়া
নুন স্বাদ অনুযায়ী
হলুদ আন্দাজমত
পদ্ধতি:
ইলিশ লেজাটা নুন হলুদ মাখিয়ে সর্ষের তেলে বেশ কড়া করে ভেজে নিতে হবে।তারপর ভালো করে সব কাঁটা বাদ দিয়ে ছাড়িয়ে নিতে হবে।মাছ ভাজা তেলে 2টো কাঁচা পেঁয়াজ,শুকনো লঙ্কা ভেজে নিয়ে মাছ,পেঁয়াজ শুকনো লঙ্কা,নুন দিয়ে ভালো করে মেখে নিতে হবে।এরপর খানিকটা কাঁচা তেল আর পাতিলেবুর রস ছড়িয়ে নিলে ভর্তা তৈরি।ভর্তাটা গোল বা চৌকো যেমন খুশি আকার দিয়ে মেখে গরম বাসমতি চালের সাথে খেলে ভাতঘুম দেওয়া আর কেউ আটকাতে পারবে না ।

ঘটিবাড়ির কুমড়োর চাটনি
বর্ষাকালে আমাদের স্কুলের সামনে খুব জল জমতো।আমি সেই নর্দমার জল,আদাড় বাদাড় পেরিয়ে কচি দিদির হাত ধরে বাড়ি ফিরতাম।তখন আমার বয়স ৫-৬ এরকম হবে ।বাড়ি ফেরার সময় রাস্তায় ঠেলাগাড়িতে লাল নীল কাঠি আইসক্রিমের দিকে জুল জুল করে তাকালে কচিদিদি মনে করিয়ে দিত লাল নীল জল গুলো নর্দমার এবং বরফটা মাছের আড়তের ।অগত্যা আমি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম । নর্দমার জল ঠেঙিয়ে বাড়ি ফেরার দু – তিন দিনের মধ্যে মালুম পড়ত দুপা ভর্তি অজস্র ফোঁড়া।বাবা মা নিয়ে ছুটতো বিমল ডাক্তারের চেম্বারে।বাড়ি ফিরে বাড়ির সবাই মিলে নেমে পড়তো এক বিচিত্র অপারেশনে।বিরাট ডিম্বাকৃতির খাবার টেবিলে আমাকে শুইয়ে গরম জল সহযোগে সেই ফোঁড়াগুলো ফাটিয়ে তাতে নিয়সপোরিন লাগানো হতো।এই পুরো কর্মকাণ্ডে আমি এই শর্তে রাজি হতাম যে ছোড়দিদা আইসক্রিম খাওয়াবে ।পর্ব শেষে একটা টিফিন বাক্স দিত ছোড়দিদা যাতে সকাল থেকে দুধ আর আম চটকে ফ্রিজে জমিয়ে রেখেছিল। ছোড়দিদা আমার ইয়ার বকশি ছিল।আমরা দুজনেই বিশ্বাস করতাম পাশের বাড়ির তালগাছে একানড়ে থাকে আর নিমগাছটায় থাকে ব্রহ্মদৈত্যি।একদিন দুপুরে আপেল সেদ্ধ খাচ্ছিলাম না বলে সেই ব্রহ্মদৈত্যিটা এসেছিল নেমে -ইয়াবড় তার কান আর চোখগুলো জ্বলছিল।বাকিটা আর মনে নেই ,ততক্ষনে আমি দিদার আঁচলে মুখ লুকিয়ে ফেলেছি।এত ধেড়ে হয়েও আমি বিশ্বাস করি তেনারা আছেন সেখানে। ছোড়দিদা চিনির পোকা ছিল তাই চা খেতো বাতাসা দিয়ে। রান্নাপুজোয় ডাল নাড়তো একহাতে আর গুড় ঢালত অন্য হাতে।এহেন ছোড় দিদার হোঁপা চিংড়ি আর কুমড়োর চাটনি ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের। রান্নাপুজোর দিন চুপি চুপি যেতাম আর দিদা এক আঙুল চাটনিতে ডুবিয়ে আমায় খাইয়ে দিত।সেই স্বর্গীয় স্বাদ ভোলার নয়।আমিও রন্ধনপটীয়সী বলে নাম কেনার হলে চোতা খুঁজে চালিয়ে দি সেই স্পেশাল চাটনিটা।
উপকরণ:
পাকা কুমড়ো একটা ছোট বাটি, ছোট করে কাটা
তেতুঁলের পাল্প ৫ চা চামচ
১ চা চামচ সর্ষের তেল
গুড় ২০০ গ্রাম
পাঁচফোড়ন ৫ গ্রাম
শুকনো লঙ্কা ৫ টা
পদ্ধতি:
পাঁচফোড়ন শুকনো খোলায় ভেজে গুঁড়ো করে নিতে হবে। কড়াইতে তেল গরম করে শুঁকনো লঙ্কা ফোড়ন দিতে হবে।এরপর কুমড়ো দিয়ে হালকা আঁচে ৩-৪ মিনিট ভেজে সামান্য জল দিতে হবে। কুমড়ো সিদ্ধ হয়ে গেলে তেতুঁলের পাল্প দিয়ে আরো একটু ফোটাতে হবে। ঘন হয়ে গেলে গুড় মিশিয়ে আর একটু ফোটাতে হবে।সবশেষে ভাজা পাঁচফোড়ণ ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে।ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশন করতে হবে এই টক মিষ্টি চাটনি শেষ পাতে।

Fataye diso bondhu!! Feeling proud. 🙂
LikeLike